শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্বাচন কমিশনের ‘শর্ত’ পূরণ করে চারটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পায়। এর মধ্যে তিনটি দলের নিবন্ধন নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন সরকারের ইচ্ছায় ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য এ তিনটি দলকে নিবন্ধন দিয়েছিল কমিশন।
প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ভাঙার অংশ হিসেবেও এটা করা হয়েছে। পাশাপাশি ওই সময় সরকারের সায় না থাকায় অনেক যোগ্য দলকে নিবন্ধন বঞ্চিত হতে হয়েছে।
এদিকে ইসির সিদ্ধান্তে বঞ্চিত হয়ে বেশকিছু দল শেখ হাসিনার সরকারের আমলে উচ্চ আদালতে রিট করে। এর মধ্যে ৬টি দল আদালতের মাধ্যমে নিবন্ধন আদায়ও করে। আবার কিছু দল ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গেলেও ওই সময়ে তাদের ইতিবাচক ফল মেলেনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে আদালতের রায় ও ইসির বিবেচনায় ৬টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেয়েছে। আদালতের আদেশে সর্বশেষ ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টিকে (বিএমজেপি) নিবন্ধন দিয়েছে কমিশন।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করলেও ওই সময়ে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। পরে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়।
ওই বছর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধনের জন্য ১১৭টি আবেদন পড়ে। এর মধ্যে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ৩৯টি দল নিবন্ধন পায়। পরে আরো ১৬টি দল নিবন্ধন পায়। এর মধ্যে শেখ হাসিনার সময়কালে ১০টি ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ৬টি দল নিবন্ধন পেয়েছে।
নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৫টি দলের নিবন্ধন বাতিল হয়। এর মধ্যে ইসির শর্ত অনুযায়ী গঠনতন্ত্র জমা দিতে না পারায় ২০০৯ সালে ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন বাতিল হয়। আদালতের ‘আদেশে’ ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে ইসি।
নিবন্ধন বাতিলের হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে দলটি উচ্চ আদালতে আপিল দায়ের করেছে। এদিকে ইসির শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হওয়ায় প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টি-পিডিপি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা’র নিবন্ধন বাতিল করে ইসি।
ওয়ান ইলেভেনের সময় গঠিত পিডিপি কিংস পার্টি নামে পরিচিত ছিল। এর মধ্যে ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি ইসি জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার নিবন্ধন বাতিলের পর ওই বছরই দলটির পক্ষ থেকে আদালতে রিট করা হয়। গত ১৯ মার্চ আদালত শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে।
শেখ হাসিনার সরকারের সময় নির্বাচন কমিশন ‘শর্ত পূরণ’ সাপেক্ষে ৪টি দলের নিবন্ধন দিয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট) নিবন্ধন পায়। এর মধ্যে বিএনএফ’র নিবন্ধন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
বিএনপি থেকে বেরিয়ে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ২০১২ সালের ১০ আগস্ট দলটি গঠনের এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর নিবন্ধন পায়। অভিযোগ রয়েছে এ দলটিকে নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারের আশীর্বাদ ছিল।
মাঠ পর্যায়ে অফিস না থাকা সত্ত্বেও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ইসির মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চাপ দিয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। কিংস পার্টিখ্যাত এ দলটি নিবন্ধনের সময়ে দলীয় প্রতীক ‘গমের শীষ’ দাবি করেছিল। গমের শীষ প্রতীকটি অনেকটা বিএনপির প্রতীক ধানের শীষের মতো দেখতে হওয়ায় বিএনপি ওই সময় কমিশনে গিয়ে আপত্তি জানায়।
পরে অবশ্য কমিশন দলটির জন্য ‘বাঘ’ প্রতীক বরাদ্দ করে। এ দলটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০২৩ সালে নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বি.এস.পি) নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অভিযোগ ছিল। সুপ্রিম পার্টির প্রধান কার্যালয়ের মালিকানা নিয়ে ইসিতে অভিযোগ জমা পড়লেও ওই সময় তা আমলে না নিয়ে দলটিকে ইসি নিবন্ধন দেয়। গোয়েন্দা সংস্থার চাপে এ দল দুটিকে নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়টি ইসিতে ওপেন সিক্রেট ছিল।
এদিকে আদালতের আদেশে আওয়ামী লীগ আমলে ‘তৃণমূল বিএনপি’কে নিবন্ধন দেওয়া হলেও দলটির নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সরকারের সহানুভূতি ছিল। এক সময়কার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার গঠিত এ দলটির মাধ্যমে বিএনপির দলছুটদের ২০২৪ সালের ভোটে আনতে এ দলটিকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল।
তৃণমূল বিএনপির মাধ্যমে বিএনপির দলছুট শমসের মবিন চৌধুরী, তৈমূর আলম খন্দকারসহ বেশ কয়েকজন সাবেক এমপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভরাডুবির শিকার হন।
২০২৩ সালে যেসব দলকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দেয় তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। সংস্কার কমিশন তার প্রতিবেদনে আউয়াল কমিশনের সময়কার ‘তৃণমূল বিএনপি’, ‘ইনসানিয়াত বিপ্লব-বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম’, এবং ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি’র নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠার কথা উল্লেখ করেন।
কমিশন ২০২৩ সালে যেসব বিতর্কিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দিয়েছে যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে সেগুলোর নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করেছে ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
এদিকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বেশকিছু দলকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। এগুলোর কয়েকটি আদালতের শরণাপন্ন হয়ে নিবন্ধন পায়।
এর মধ্যে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল, ২০১৯ সালে ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম) ও বাংলাদেশ কংগ্রেস, ২০২৩ সালে ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জাসদ নিবন্ধন পায়।
এছাড়া শেখ হাসিনার পতনের পর ২০২৪ সালে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি ও গণসংহতি আন্দোলন এবং ২০২৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) আদালতের আদেশে নিবন্ধন পেয়েছে।
উচ্চ আদালতের আদেশে সর্বশেষ গত ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টিকে (বিএমজেপি) নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর বাইরে আগের আবেদন পুনর্বিবেচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গণঅধিকার পরিষদ ও নাগরিক ঐক্যকে কমিশন নিবন্ধন দিয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে আদালতের আদেশে গত ২ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধন পেয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)। দলটির চেয়ারম্যান অ্যাড. এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম চান মনে করেন, ফ্যাসিস্ট সরকার থাকলে তাদের পক্ষে রায় আসার সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ।
সরকারের ইচ্ছাতেই শুনানি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করা হয়েছে দাবি করে দলটির চেয়ারম্যান আমার দেশকে বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের আবেদন নাকচ করে দেওয়ার পর আমরা আদালতে রিট করি। কিন্তু আদালতে গিয়ে দেখি অদৃশ্য কারণে আমাদের রিটের শুনানি হয় না। বেশিরভাগ সময়ই তাদের মামলা তালিকায় পেছনের দিকে রাখা হতো। কখনো কখনো সামনের দিকে এলেও দেখা যেত শুনানি না করে কোর্ট মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছে।
এভাবে দিনের পর দিন আমাদের ঘোরানো হয়েছে। সরকার পরিবর্তন না হলে তাদের অপেক্ষার শেষ হতো না বলে মনে করেন বিডিপির চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি)’র প্রেসিডেন্ট সুকৃতি কুমার মণ্ডল আমার দেশকে বলেন, আমাদের দল, আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ আরো কয়েকটি দল ইসির শর্ত পূরণ করলেও সাবেক সরকারের আমলে আমাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, আমি অনেকটাই নিশ্চিত ছিলাম শেখ হাসিনার আমলে আদালতে গিয়েও ন্যায়বিচার পাব না। দেখা যাচ্ছে হাইকোর্টে রায় পেলেও আপিল বিভাগে আটকে দেওয়া হতো। এজন্য আমরা ওই সময় রিটও করিনি।
এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলনসহ আমাদের সমযোগ্যতার দলগুলো রিট করেও শেখ হাসিনার সময়ে পক্ষে রায় পাননি। বার বার তাদের সময় পেছানো হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে তারা রায় পেয়ে নিবন্ধন পেয়েছে। আমরা দেরি করে রিট করার কারণে নিবন্ধন পেতে কিছুটা বিলম্ব হলো।
নির্বাচনিব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার দেশকে বলেন, ওই সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় দলগুলোর নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। দল ভাঙার অংশ হিসেবে নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য নয় এমন দলগুলোকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। বড় দলগুলো থেকে লোক বাগিয়ে তারা নিবন্ধন দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে এটা করেছিল। তিনি আরো বলেন, এজন্য আমরা কমিশন থেকে ওই সময়কার নিবন্ধনের বিষয়টি তদন্ত করার সুপারিশ করেছি। বলেছি অযোগ্য কাউকে নিবন্ধন দেওয়া হলে তা বাতিল করতে। তদন্ত হলে যোগ্য কেউ ওই সময় বাদ পড়লেও তাদেরও বিবেচনায় আনার সুযোগ থাকবে।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আমার দেশকে বলেন, দলগুলো নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণের পরে নিবন্ধন পায়নি কিংবা শর্ত পূরণ না করার কারণে নিবন্ধন পায়নি সেটা ডকুমেন্ট না দেখে তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারব না। তবে এটা সত্য সংক্ষুব্ধ ছিল বলেই তারা আদালতে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, আদালত তাদের নিবন্ধন দেওয়ার জন্য আমাদের আদেশ দিয়েছেন আমরা সেই আদেশ পালন করেছি। আর আদালতে তখন ন্যায়বিচার পাননি, এখন পেয়েছেন এটা বলার এখতিয়ার আমার নেই। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরাই এটা ভালো বলতে পারবেন।
Comments 0